কোন দেশ বা জাতির ইতিহাস সে দেশের বিভিন্ন যুগের সামাজিক, সাংস্কৃতি, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনের প্রতিচ্ছবি। ইতিহাস হলাে মানুষের সামাজিক সংগঠন ও উন্নয়নের কালপঞ্জির সঠিক ও বিজ্ঞানসম্মত বিবরণ। ইতিহাসের বিষয়বস্তু হচ্ছে মানুষের জীবনধারা, মানুষের সমাজ ও পরিবেশ তথা মানুষের সভ্যতার কালক্রমিক বর্ণনা। লিখিত ও অলিখিত নানা উপাদানের উপর নির্ভর করে ইতিহাস লিখিত হয়। সমকালীন সাহিত্য, ধর্মগ্রন্থ, পর্যটকদের বিবরণী, সরকারি দলিল-পত্র, রাজা-বাদশা, শাসকদের জীবনী ইত্যাদি লিখিত উপাদানের উপাত্ত। অলিখিত উপাদানের মধ্যে পড়ে- ধর্মীয় ও সাধারণ স্থাপত্য, ভাস্কর্য, মুদ্রা, তাম্রলিপি, শিলালিপি, মানুষের ব্যবহার্য বাসন-কোসন, চিত্রকলা ইত্যাদি। ইতিহাস মানুষের অতীতকে জানতে সাহায্য করে, বর্তমান চলার পথের দিক নির্দেশনা দেয়। দেশ, জাতি গঠন ও উন্নয়নের পথ দেখায়। সর্বোপরি ইতিহাস পাঠে মানুষ কর্মকুশলী ও দেশপ্রেমিক হিসেবে গড়ে ওঠে।
ইতিহাসের সংজ্ঞা:
ইতিহাস শব্দটা ইংরেজি History শব্দের বাংলা অনুবাদ। History শব্দটি গ্রিক Historia থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। | Historia বা History শব্দের আভিধানিক অর্থ অনুসন্ধান বা গবেষণা। আবার ইতিহাস শব্দটি ইতিহ’ শব্দ থেকে গঠিত হয়েছে। ইতিহ’ অর্থ ঐতিহ্য। অতএব, মানব সভ্যতার ঐতিহ্যের ধারাবাহিক বিবরণকে ইতিহাস বলে। বিখ্যাত ইতিহাসবিদগণ ইতিহাসের বিভিন্ন সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে কয়েকটা উল্লেখযােগ্য সংজ্ঞা তুলে ধরা হল :
•ডক্টর জনসন বলেন, “যা কিছু ঘটে তা-ই ইতিহাস।” তিনি আরাে বলেন, “অতীতের কাহিনী মাত্রই ইতিহাস।” |
•ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদারের মতে, “ইতিহাস হলাে মানব সমাজের অতীত কার্যাবলির বিবরণী।”
•টয়েনবি বলেন, “সমাজের জীবনই ইতিহাস। প্রকৃতপক্ষে মানব সমাজের অনন্ত ঘটনা প্রবাহই ইতিহাস।”
•ঐতিহাসিক র্যাপসন বলেন, “ঘটনার ক্রমিক এবং বৈজ্ঞানিক বিবরণই ইতিহাস।”
•ইতিহাস শাস্ত্রবিদ ই.এইচ.কার মনে করেন যে, “ইতিহাস হলাে বর্তমান ও অতীতের মধ্যে অন্তহীন সংলাপ।”
তিনি আরাে মনে করেন যে, “ইতিহাস হলাে ঐতিহাসিক ও তথ্যের মধ্যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার এক অব্যাহত প্রক্রিয়া।” মূলত ইতিহাস হচ্ছে অতীতকালীন সময়কার মানব সমাজের ঘটনা প্রবাহের ধারাবাহিক বিবরণী, যার মাধ্যমে তক্কালীন সমাজ, রাষ্ট্রব্যবস্থা, সংঘাত, সম্প্রীতি তথা মানব সভ্যতার ভাঙাগড়ার পর্যালােচনামূলক ইতিকথা।
ইতিহাসের বিষয়বস্তু:
তাৎপর্যপূর্ণ ও গ্রহণযােগ্য ঘটনা
মানব জীবনের গতিধারা সৃষ্টির সূচনা থেকে যা কিছু ঘটেছে, সবকিছুই ইতিহাস। কিন্তু ঘটে যাওয়া সকল কর্মকাণ্ড ইতিহাসে স্থান পায় না, বরং যে সব ঘটনা বা বিষয় তাৎপর্যপূর্ণ ও গ্রহণযােগ্য বলে মনে হয়, তা-ই সাধারণত ইতিহাসে স্থান পায়। এসব ঘটনাই ইতিহাসের বিষয়বস্তু।
মানুষের সমাজ, সভ্যতা ও জীবনধারা
ইতিহাসের অন্যতম বিষয়বস্তু হলাে মানুষ ও তার পরিবেশ, সমাজ, সভ্যতা এবং জীবনধারা। ইতিহাস শুধুমাত্র ঘটনার সমষ্টি নয়, ঘটনার অন্তরালে বিদ্যমান পরিস্থিতির বিশ্লেষণও ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত।
মানব জীবনের বিকাশ ধারা
ইতিহাসের অন্যতম বিষয়বস্তু হলাে মানব জীবনের বিকাশের ধারাবিবরণী। মানুষ জন্মলগ্ন থেকে প্রতিনিয়ত পরিবেশের সাথে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। শুরুতে মানুষ সম্পূর্ণরূপে প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল ছিল। এই নির্ভরশীলতা যতই কমেছে, মানুষ ততই স্বাধীন ও স্বনির্ভর হয়েছে। ইতিহাস এসব বিষয় নিয়েও আলােচনা করে।
আদিম সভ্যতা
মানুষের আদিম সভ্যতা ও তার ক্রমবিকাশ ইতিহাসের অন্যতম বিষয়বস্তু। এক সময় মানুষ ছিল গুহাবাসী। সভ্যতার সর্বনিম্ন স্তরে তার অবস্থান ছিল। শিকার, মাছধরা এবং ফলমূল সংগ্রহ ছিল আদিম মানুষের জীবিকা। এরপর ধীরে ধীরে মানুষ জীবিকার ও অর্থনীতির উন্নতি সাধন করে উদ্বৃত্ত উৎপাদনে সক্ষম হয়েছে। এ সব বিবরণ ইতিহাসের বিষয়বস্তু।
সভ্যতার বিকাশধারা
মানুষের সমাজ-সভ্যতা বিকাশের ধারাবিবরণীও ইতিহাসের অন্যতম বিষয়বস্তু। সভ্যতা বিকাশের এক পর্যায়ে মানুষ এক সময় গড়ে তােলে গ্রাম, গ্রাম থেকে নগর, নগর থেকে রাজ্য, রাজ্য থেকে সাম্রাজ্য। মানুষের এ জয়যাত্রার পথ সুগম ছিল না । সমস্যা সঙ্কুল এপথে মানুষের সংগ্রামের সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। তাই বলা যায়- মানব সভ্যতার অগ্রগতি, জয়যাত্রা, সাফল্য-ব্যর্থতা সবকিছুই ইতিহাসের বিষয়বস্তু।